ওলামায়ে কেরামকে মাইনাস করে দ্বীন প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন: এক দুঃস্বপ্নের দিগন্ত
ইসলামের ইতিহাসে ওলামায়ে কেরামের ভূমিকা অবিস্মরণীয়। তাঁরা হলেন আল্লাহর কিতাব ও রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সুন্নাহর প্রকৃত ধারক-বাহক, যাদের মাধ্যমে ইসলামের প্রচার ও প্রসার হয়েছে এবং সমাজে দ্বীনের আলো জ্বলেছে। কিন্তু বর্তমান সময়ে কেউ কেউ ধারণা করছেন যে, ওলামাদের ছাড়াই দ্বীন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। এই চিন্তা চরম বিভ্রান্তিমূলক এবং বিপজ্জনক। ওলামাদের বাদ দিয়ে কোনো দ্বীনি আন্দোলন বা সমাজ সংস্কার দীর্ঘমেয়াদে সফল হতে পারে না।
ওলামাদের ভূমিকা ও মর্যাদা কুরআন ও হাদিসে
১. কুরআনে ওলামাদের মর্যাদা:
আল্লাহ তাআলা স্পষ্টভাবে বলেছেন,
يَرْفَعِ اللّٰهُ الَّذِيْنَ اٰمَنُوْا مِنْكُمْ وَالَّذِيْنَ اُوْتُوا الْعِلْمَ دَرَجٰتٍ ۚ
"আল্লাহ ঈমানদারদের মধ্যে তাদের মর্যাদা বৃদ্ধি করবেন, যারা জ্ঞানপ্রাপ্ত।"
— (সূরা মুজাদিলা: ১১)
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা ওলামাদের বিশেষ মর্যাদা দিয়েছেন, কারণ তাঁরা আল্লাহর নিকট বিশেষ জ্ঞানের অধিকারী। দ্বীনের প্রচার ও প্রসারে তাঁদের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। আলেমগণ সেই ব্যক্তিরা, যারা ইসলামের মুলনীতি, আইন, এবং মূল্যবোধ সঠিকভাবে জানেন এবং মানুষকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে পারেন।
২. কুরআনে জ্ঞানের গুরুত্ব:
আল্লাহ তাআলা আরও বলেন,
قُلْ هَلْ يَسْتَوِي الَّذِيْنَ يَعْلَمُوْنَ وَالَّذِيْنَ لَا يَعْلَمُوْنَ ۗ اِنَّمَا يَتَذَكَّرُ اُولُوْا الْاَلْبَابِ
"বলুন, যারা জানে আর যারা জানে না, তারা কি সমান হতে পারে? শুধু বুদ্ধিমানরাই শিক্ষা গ্রহণ করে।"
— (সূরা যুমার: ৯)
আল্লাহ তাআলা এখানে সরাসরি জানিয়ে দিয়েছেন যে জ্ঞানীদের মর্যাদা অন্যদের থেকে আলাদা এবং শ্রেষ্ঠ। ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা এবং পথ প্রদর্শনে আলেমদের ভূমিকা অপরিহার্য।
৩. হাদিসে ওলামাদের মর্যাদা:
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন:
"العلماء ورثة الأنبياء، إن الأنبياء لم يورثوا دينارا ولا درهما، إنما ورثوا العلم، فمن أخذه أخذ بحظ وافر."
"আলেমগণ নবীদের উত্তরাধিকারী। নবীগণ কোনো দিনার বা দিরহাম রেখে যাননি; তারা ইলম রেখে গেছেন। যারাই ইলম গ্রহণ করে, তারা এক বিশাল অংশ গ্রহণ করে।"
— (তিরমিজি: ২৬৮২)
এই হাদিসে আলেমদের নবীদের উত্তরসূরি হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে, যারা দ্বীনের শিক্ষার প্রকৃত ধারক-বাহক। নবীগণ যেমন মানুষের কাছে আল্লাহর নির্দেশাবলী পৌঁছে দিতেন, তেমনই আলেমগণ কিয়ামত পর্যন্ত সেই দায়িত্ব পালন করবেন। সুতরাং, আলেমদের বাদ দিয়ে দ্বীন প্রতিষ্ঠার চিন্তা চরম ভ্রান্তি।
৪. আলেমদের মৃত্যুর মাধ্যমে ইলমের ধ্বংস:
রাসূলুল্লাহ (সা.) আরও বলেছেন:
"إِنَّ اللَّهَ لَا يَقْبِضُ الْعِلْمَ انْتِزَاعًا يَنْتَزِعُهُ مِنَ الْعِبَادِ وَلَكِنْ يَقْبِضُ الْعِلْمَ بِقَبْضِ الْعُلَمَاءِ حَتَّى إِذَا لَمْ يُبْقِ عَالِمًا اتَّخَذَ النَّاسُ رُءُوسًا جُهَّالًا فَسُئِلُوا فَأَفْتَوْا بِغَيْرِ عِلْمٍ فَضَلُّوا وَأَضَلُّوا."
"আল্লাহ ইলম (জ্ঞান) উঠিয়ে নেবেন না সরাসরি বান্দাদের থেকে, বরং তিনি ইলম উঠিয়ে নিবেন আলেমদের (মৃত্যুর মাধ্যমে), এমনকি যখন কোনো আলেম অবশিষ্ট থাকবে না, তখন লোকেরা মূর্খদের নেতা বানাবে। তাদের থেকে ফতোয়া চাওয়া হবে, তারা ইলমহীন ফতোয়া দেবে, ফলে তারা নিজেরাও ভ্রষ্ট হবে এবং অন্যদেরও ভ্রষ্ট করবে।"
— (সহীহ বুখারি: ১০০)
এই হাদিস থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে, যখন সমাজ থেকে আলেমদের গুরুত্ব ও নেতৃত্ব হারিয়ে যায়, তখন মূর্খ নেতারা সমাজের নেতৃত্ব গ্রহণ করে, যা দ্বীন ও দুনিয়ার উভয় দিক থেকেই বিপর্যয়কর হয়।
ওলামাদের পরিত্যাগ: একটি বিপজ্জনক প্রবণতা
বর্তমান সময়ে দেখা যাচ্ছে, কিছু মানুষ ওলামাদের অবমূল্যায়ন করে বা তাদের বাদ দিয়ে দ্বীন প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখে। এই চিন্তা শুধু ইসলামিক শরিয়তের সাথে সাংঘর্ষিক নয়, বরং এটি মুসলিম উম্মাহকে বিপর্যয়ের দিকে নিয়ে যায়। ইসলামের ইতিহাসে ওলামাদের নেতৃত্বে দ্বীন প্রতিষ্ঠা হয়েছে এবং তাঁরা ছাড়া কোনো সঠিক পথনির্দেশনা সম্ভব নয়।
আল্লাহ তাআলা কুরআনে নির্দেশ দিয়েছেন,
"فَسْئَلُوا أَهْلَ الذِّكْرِ إِنْ كُنْتُمْ لَا تَعْلَمُونَ"
"তোমরা যদি জানো না, তবে জ্ঞানীদের নিকট জিজ্ঞাসা কর।"
— (সূরা নাহল: ৪৩)
এই আয়াত থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে আল্লাহ তাআলা মানুষকে নির্দেশ দিয়েছেন ওলামাদের থেকে জ্ঞান অর্জন করতে, তাঁদের পরামর্শ ও নেতৃত্ব গ্রহণ করতে।
১. ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন (ভারতীয় উপমহাদেশ)
প্রমাণ:
- ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহে মাওলানা ফজলে হক খৈরাবাদী নেতৃত্ব দেন এবং ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ফতোয়া জারি করেন। এই ফতোয়া বিদ্রোহকে ধর্মীয় বৈধতা দেয়, যা মুসলিমদের সক্রিয়ভাবে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করে।
- দারুল উলুম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠা (১৮৬৬): ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ইসলামী শিক্ষা ও রাজনৈতিক চেতনা জাগ্রত করার উদ্দেশ্যে এই মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। শেখুল হিন্দ মাওলানা মাহমুদুল হাসান এবং অন্যান্য দেওবন্দি আলেমরা সরাসরি ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের নেতৃত্ব দিয়েছেন।
- “রেশমি রুমাল” আন্দোলন: ১৯১৬ সালে মাওলানা মাহমুদ হাসান দেওবন্দী এবং মাওলানা উবায়দুল্লাহ সিন্ধি রেশমি রুমালের মাধ্যমে গুপ্ত বার্তা পাঠিয়ে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে একটি ইসলামী বিপ্লবের পরিকল্পনা করেন।
রেফারেন্স:
- H. M. Seervai, Constitutional Law of India
- Barbara D. Metcalf, Islamic Revival in British India: Deoband, 1860-1900
২. খিলাফত আন্দোলন
প্রমাণ:
- ১৯১৯ সালে শুরু হওয়া খিলাফত আন্দোলনের মূল নেতৃত্বে ছিলেন মাওলানা মুহাম্মদ আলী জওহর এবং মাওলানা শওকত আলী। তাঁদের নেতৃত্বে মুসলিমরা ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে এবং তুর্কি খিলাফতের পুনঃস্থাপনের দাবি তোলে।
- এই আন্দোলনের অন্যতম লক্ষ্য ছিল ইসলামী ঐক্য এবং মুসলিম সমাজকে ব্রিটিশদের থেকে স্বাধীন করা, যা ভারতের রাজনৈতিক আন্দোলনের অংশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
রেফারেন্স:
- Gail Minault, The Khilafat Movement: Religious Symbolism and Political Mobilization in India
- Ayesha Jalal, Self and Sovereignty: Individual and Community in South Asian Islam Since 1850
৩. ইরানের ইসলামী বিপ্লব (১৯৭৯)
প্রমাণ:
- আয়াতুল্লাহ খোমেনি ১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামী বিপ্লবের নেতৃত্ব দেন, যা শাহ সরকারের পতন ঘটায় এবং একটি ইসলামী প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে। বিপ্লবের প্রেক্ষাপটে খোমেনি এবং অন্যান্য আলেমরা "ইসলামী সরকার" ধারণার প্রচার করেছিলেন।
- ইরানের জনগণ ওলামাদের নেতৃত্বে শাহের বিরোধিতা করে, যার ফলে ইসলামী আইন (শরিয়াহ) ভিত্তিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়।
রেফারেন্স:
- Ervand Abrahamian, Iran Between Two Revolutions
- Vali Nasr, The Shia Revival: How Conflicts within Islam Will Shape the Future
৪. আলজেরিয়ার স্বাধীনতা সংগ্রাম
প্রমাণ:
- শেখ আব্দুল হামিদ ইবনে বাডিস আলজেরিয়ায় ফরাসি ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে সংগ্রামে নেতৃত্ব দেন। ১৯৩১ সালে প্রতিষ্ঠিত Muslim Ulema Association আলজেরিয়ানদের মধ্যে ইসলামী ঐক্য এবং শিক্ষার প্রচার করে এবং ফরাসি সংস্কৃতির বিরোধিতা করে।
- তাঁদের প্রচেষ্টায় আলজেরিয়ার স্বাধীনতা সংগ্রাম আরও সংগঠিত হয়, এবং ধর্মীয় আদর্শবাদী শিক্ষায় উদ্বুদ্ধ হয়ে জনগণ স্বাধীনতার জন্য জেগে ওঠে।
রেফারেন্স:
- John Ruedy, Modern Algeria: The Origins and Development of a Nation
- Ali Merad, *Islam in Algeria: Religion, Society and Politics
উপসংহার:
ওলামায়ে কেরামকে বাদ দিয়ে কোনো দ্বীনি উদ্যোগ বা ইসলামী পুনর্জাগরণের স্বপ্ন শুধু ভুল নয়, বরং তা চরম বিপর্যয়ের দিকে নিয়ে যায়। কুরআন ও হাদিসের অসংখ্য দলিল-প্রমাণ আমাদের শেখায় যে, ওলামারা হলেন ইসলামের মূল ধারক এবং তাঁদের নেতৃত্ব ছাড়া কোনো দ্বীন প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা সফল হতে পারে না। তাই, ওলামায়ে কেরামের মর্যাদা ও তাঁদের ভূমিকার প্রতি সর্বদা সম্মান দেখানো উচিত এবং তাঁদের পথনির্দেশনায় ইসলামের প্রচার ও প্রতিষ্ঠা করা উচিত।
- মুফতি শাব্বির আহমাদ