দুটি গল্পের মিশেলে এক প্রেরণার বার্তা

দুটি গল্পের মিশেলে এক প্রেরণার বার্তা

গল্প -১

একদিন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মসজিদে সাহাবীদের সাথে বসে ছিলেন। এই সময় একজন নারী তার শিশুকে ডেকে বললেন- "বাচ্চা, আমি তোমাকে কিছু দেবো।" রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার দিকে তাকিয়ে বললেন, "তুমি তাকে কী দিতে চাও?" তখন নারী উত্তর দিলেন, "আমি তাকে একটি খেজুর দেবো।"

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেই নারীকে সতর্ক করে বললেন, "তুমি যদি তাকে কিছু না দাও, তবে এটা মিথ্যা হয়ে যাবে।" তিনি আরও বললেন, "যদি তুমি তাকে খেজুর দাও, তবে তা সত্যি হবে। কিন্তু যদি তুমি কিছু না দাও এবং শুধু তাকে মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দাও, তাহলে তা মিথ্যা হিসেবে গণ্য হবে।"
এই হাদিসটি মুসনাদে আহমদে এসেছে:
دَعُوتُهُ لِأُعْطِيَهُ تَمْرَةً. فَقَالَ: أَمَا إِنَّكِ لَوْ لَمْ تُعْطِيهِ شَيْئًا كُتِبَتْ عَلَيْكِ كِذْبَةٌ
(মুসনাদে আহমদ, হাদিস: ১৯৭৭৩)
অর্থ: “তুমি তাকে খেজুর দেওয়ার কথা বলেছো, যদি তুমি কিছু না দাও, তবে তা মিথ্যা হিসেবে গণ্য হতো।”

শিক্ষণীয় দিক:

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই ঘটনা দিয়ে আমাদের শিখিয়েছেন যে, আমাদের উচিত মিথ্যা না বলা, বিশেষ করে যখন এটি শিশুদের ব্যাপারে হয়। মিথ্যা কখনোই একটি মুসলিমের চরিত্র হতে পারে না। এমনকি শিশুদের মাঝে সততার শিক্ষা দেয়ার সময়ও রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সততা ও সত্যবাদিতার সবচেয়ে বড় উদাহরণ ছিলেন।
আজকের যুগে অনেক সময় আমরা ছোট-বড় সকলেই মিথ্যা কথা বলি, বিশেষত শিশুদেরকে সন্তুষ্ট করতে বা তাদেরকে কিছু দিতে প্রলোভন দেখাতে। কিন্তু রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর মাধ্যমে আমাদের শিখিয়েছেন যে, মিথ্যা কোনো অবস্থাতেই গ্রহণযোগ্য নয়, এমনকি এটি একটি শিশুর জন্যও হতে পারে না। তিনি মিথ্যার বিষয়ে এত সতর্ক ছিলেন যে, যদি মিথ্যা কোনো গল্প বলেও শিশুদের হাসানো হয়, তবে সেটি তার জন্য বড় ধরনের অপ্রীতিকর ফল হতে পারে।
কুরআনের দলিল:
আল্লাহ তায়ালা কুরআনে সৎ, সত্য ও ন্যায়ের ব্যাপারে নির্দেশনা দিয়েছেন:
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ وَكُونُوا مَعَ الصَّادِقِينَ
(সূরা আত-তাওবা, আয়াত ১১৯)
অর্থ: "হে মুমিনগণ! আল্লাহকে ভয় করো এবং সৎকর্মীদের সঙ্গী হও।"
এছাড়াও, কুরআনে মিথ্যার প্রতি কঠোর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে:
وَلَا تَقْفُ مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ
(সূরা আল-ইসরা, আয়াত ৩६)
অর্থ: "তোমরা এমন কিছু অনুসরণ করো না যার সম্পর্কে তোমাদের কোনো জানা নেই।"
এটি প্রমাণ করে যে মিথ্যা বা ভিত্তিহীন কথাবার্তা এবং প্রতিশ্রুতি দেওয়া ইসলামে নিষিদ্ধ।

উপসংহার:
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবন ছিল সততা, ন্যায় এবং সত্যের একটি মহান উদাহরণ। তিনি কখনোই মিথ্যা বলতেন না, এমনকি শিশুদের সাথে কথাবার্তা বলার সময়ও তিনি সততা বজায় রাখতেন। তার জীবনের এই দৃষ্টান্ত আমাদের জন্য একটি অমূল্য শিক্ষা, যেখানে আমাদের সন্তানদের প্রতি দায়িত্বশীল, সতর্ক এবং সত্য কথা বলা উচিত।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এই মিথ্যা থেকে সতর্ক থাকার শিক্ষা আমাদের সমাজের প্রতিটি স্তরে প্রয়োগ করতে হবে, বিশেষত যখন আমরা শিশুদের সঙ্গে কথা বলি, যাতে তারা সত্য এবং সততার গুরুত্ব বুঝতে পারে এবং তা অনুসরণ করতে পারে।

গল্প -২


একদিন, এক বৃদ্ধা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এসে জানতে চাইলেন, “ইয়া রাসুলুল্লাহ! আমি কি জান্নাতে প্রবেশ করবো?” রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মৃদু হাসলেন এবং স্নেহপূর্ণ ভঙ্গিতে বললেন:
"إِنَّ الْجَنَّةَ لَا تَدْخُلُهَا عَجُوزٌ"
অর্থাৎ, "জান্নাতে তো কোনো বৃদ্ধা প্রবেশ করবে না।"
বৃদ্ধা এ কথা শুনে কিছুটা চিন্তিত ও মর্মাহত হলেন। তিনি ভাবলেন, তার বৃদ্ধ বয়সের কারণে বুঝি তিনি জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবেন না। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার মুখের অভিব্যক্তি দেখে বুঝতে পারলেন যে, তিনি মন খারাপ করে ফেলেছেন। তখন রাসুলুল্লাহ (সাঃ) হাসিমুখে আবার বললেন, “তুমি চিন্তা করো না। জান্নাতে প্রবেশের আগে আল্লাহ তোমাকে আবার যুবতী করবেন। তখন তুমি নতুন করে সৃষ্টি হয়ে জান্নাতে প্রবেশ করবে।”
এরপর তিনি কুরআনের একটি আয়াত তেলাওয়াত করলেন:
"إِنَّا أَنشَأْنَاهُنَّ إِنشَاءً * فَجَعَلْنَاهُنَّ أَبْكَارًا"
(সূরা আল-ওয়াকিয়া, আয়াত ৩৫-৩৬)
অর্থ: "আমি তাদেরকে নতুনভাবে সৃষ্টি করবো এবং তাদেরকে কুমারী করবো।"
রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর এই ব্যাখ্যা শুনে বৃদ্ধার মন আনন্দে ভরে উঠল, এবং তার মুখে হাসি ফুটে উঠল। তিনি বুঝলেন যে, তার জন্য জান্নাতে প্রবেশের সুযোগ রয়েছে এবং আল্লাহ তাকে আবার নতুনভাবে সৃষ্টি করবেন।

শিক্ষণীয় দিক:

এখানে একটি শিক্ষণীয় দিক আছে: রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কখনো মিথ্যা গল্প সাজিয়ে বা ভিত্তিহীন কথা বলে কাউকে হাসানোর চেষ্টা করতেন না। তার রসিকতা সবসময়ই ছিল সত্য ও বাস্তবতার উপর ভিত্তি করে। তার কথায় ছিল গভীর জ্ঞান এবং শিক্ষণীয় বার্তা। আমরা প্রায়ই শিশুদের খুশি করতে কিংবা ভয় দেখাতে মিথ্যা কথা বলে থাকি বা প্রলোভন দেখাই, যা ঠিক নয়। বরং আমাদের উচিত রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর এই মহান আদর্শ অনুসরণ করা এবং সত্যের উপর থেকে মানুষকে আনন্দ ও শিক্ষা প্রদান করা।
কীভাবে রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সত্যের মাধ্যমেই হাসি এবং শান্তি ছড়াতেন। তার প্রতিটি আচরণেই ছিল মননশীলতা, কোমলতা ও গভীর চিন্তার পরিচয়, যা আমাদের জন্য অনুসরণীয়।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url